
সূর্যের নিয়মে বিদায় নিলো ২০২৪ সাল। স্বাগত ২০২৫ সাল। ইন্টারনেট ক্র্যাকডাউনে ২০২৪ সালে সূর্যাস্ত ঘটিয়েছে ডিজিটাল থেকে স্মার্ট স্বপ্ন বুনে ১৫ বছর স্থায়ী ক্ষমতার তেজ। বিদায়ী বছরের জুলাইয়ের শেষ ১৫ দিন ডিজিটাল দুনিয়া থেকে দেশকে প্রায় বিচ্ছিন্ন করে দিয়েও শেষ রক্ষা হয়নি তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী প্রধানতম দল হয়েও ফ্যাসিবাদী ও কর্তৃত্ববাদী আচরণে ক্ষমতা ছেড়ে পালাতে হয়েছে দলের শীর্ষ নেতাকে।
নতুন করে পথ চলা শুরু করেছে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ তারুণ্যের রুধির ধারায় জাগ্রত বাংলাদেশ ২.০। তাদেরই ম্যান্ডেড নিয়ে দেশ মেরামতের কাজ শুরু করেছেন শান্তিতে নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মাদ ইউনূস। সংস্কারের প্রথম ধাপেই সার্বভৌত্ব অর্জনের মাসে বাতিল হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। নাগরিকদের সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট পাওয়ার অধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে ডিসেম্বরকে গৌরব দিয়েছে সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪। তবে নতুন বছরে ইন্টারনেটে দাম বাড়ার ঝুঁকিও তৈরি হয়েছে।
এরইমধ্যে তথ্য-প্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ খাতের দুর্নীতি, অনিয়মের ঝাঁপি খুলতে শুরু করে একের পর এক। টেলিকম খাতে বাস্তবায়নাধীন ৪৯টি প্রকল্পের সামগ্রিক মূল্যায়নে ৫ সুপারিশ দেয়া হলেও দুর্নীতির হিসাব প্রকাশ করা হয়নি। বিগত সময়ের সচিব বহাল তবিয়তে থাকায় নানা সময়ে আলোচিত ও অভিযুক্ত হুয়াওয়ে, টেলিটক ইত্যাদি প্রকল্প নিয়ে নিশ্চুপ থাকা গেছে। এমন কি অকাস্মাৎ আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর পোর্টাল সাব ডোমেইনের ওয়েবসাইটটাও কঙ্কাল হয়ে পড়ে থাকায় সংশয়ে জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে- মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট কোনটা? কঙ্কাল ওয়েব সাইটের মালিক কে?
তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের চলমান ২১ প্রকল্পে হরিলুটের প্রমাণ পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত তদন্ত কমিটি। তদন্তে দেখা গেছে, ৫টাকার জিনিস ২০ টাকায় কেনা হয়েছে। অবকাঠামোর জন্য প্রয়োজনীয় হলেও টিয়ার ফোর ডেটা সেন্টার উদ্যোগের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে এবং প্রকল্পের অপচয় নিয়ে কথা উঠছে। মনে প্রশ্ন জাগছে , দেশজুড়ে যে হারে হাই-টেক; সফটেক নামে পার্ক করা হয়েছে বা হচ্ছে সেই আবাদি জমিগুলো যদি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রয়োগে খাদ্য উৎপাদনে নিয়োজিত থাকতো তাহলে যে ব্যয় হয়েছে তার থেকে বেশি আয় হতো কি না?
এসব প্রকল্প নিয়ে ভেন্ডরগুলোর সঙ্গে অসম চুক্তি করা হয়েছে, ওপেনসোর্স প্রযুক্তিকে না রেখে প্রোপাইটরি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানদের সাথে বৈষম্য চুক্তি করার অভিযোগ এসেছে। প্রকল্প বাগিয়ে নিতে ব্যবসায়ীদের মধ্যেও দলীয় কর্মী বনে যাওয়ার প্রবণতা পৌঁছেছিলো দৃষ্টিকটু পর্যায়ে। ব্যয়ে কুণ্ঠা করা না হলেও ডিজিটাল সিকিউরিটি বলি আর গোপনীয়তা বলি তা যেনো বজ্র আটুনি ফস্কা গেড়ো পর্যায়ে নিয়ে গেছে। বেহাত হয়েছে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য। তারপরও বছরজুড়ে থাকা আতঙ্ক ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার (এনটিএমসি) এখনো রয়েছে অন্তরালে। কোথায় কেথায় ভঙ্কর ডিভাইস লাগানো আছে, কিংবা কোথা থেকে কীভাবে আনা হয়েছে সেই তথ্য নাগরিকের সামনে এখনো প্রকাশ হয়নি।
একইসঙ্গে দুই বছর ধরে ঝুলে থাকা ন্যাশনওয়াইড টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক (এনটিটিএন) পরিচালনায় ফ্রাসিস্ট দোসর হিসেবে পরিচিত দুই কোম্পানির কাছে আটকে রেখেও তাদের দিয়ে ঝুলন্ত তারের জঞ্জাল কামানো যায়নি। তড়িঘড়ি ‘ইনফ্রাস্ট্রাকচার শেয়ারিং গাইডলাইন’ করা নিয়ে ফের প্রশ্নের মুখে পড়েছে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি)। ইন্টারনেট সেবাকে মোবাইল অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়ার দূরভিসন্ধী চলছে বলে আতঙ্ক দেখা গেছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবাদাতাদের মধ্যে। অপরদিকে ভারত থেকে ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ আমদানিতে সীমাবদ্ধতা আরোপের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে বিটিআরসি। এরপর দাম কমানো প্যাকেজ নিয়ে আসে রাষ্ট্র-পরিচালিত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সাবমেরিন কেবল পিএলসি (বিএসসিপিএলসি)।
একইভাবে ব্যান্ডউইথের পরিমাণ দেশের মোট চাহিদার সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশে সীমাবদ্ধ রাখার শর্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ঘুরে দাঁড়ানো আভাস দিলেও সেবার মান ধরে রাখা নিয়ে শঙ্কা দেখা গেছে আন্তর্জাতিক ব্যান্ডউইথের পাইকারি বিক্রেতা ইন্টারন্যাশনাল ইন্টারনেট গেটওয়ে (আইআইজি) ব্যবসায়ীদের মধ্যে। এছাড়াও দুই মাসের অগ্রিম টাকা দেয়ার শর্তে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি তার নিরুৎসাহী হয়। লাইসেন্স গাইডলাইন্স অনুযায়ী, অপারেটরদের নীরিক্ষা প্রতিবেদনের ওপর রেভিনিউ ভাগাভাগি করার কথা থাকলেও এখনো মনগড়া হওয়ায় উদ্বেগ রয়েছে।
উদ্বেগ জনক হারে ডিজিটাল মাধ্যমে বাড়ছে প্রপাগণ্ডা। ফেইক নিউজ কার্ডে প্রতিদিনই সয়লাব হচ্ছে সোশ্যাল হ্যান্ডেলগুলো। বিদায়ী বছরে ফেসবুকের সঙ্গে এই হার পাল্লা দিয়ে বাড়ছে টুইটারে। এক্ষেত্রে মিডিয়াগুলোর ডিজিটাল উপস্থিতি ২০২৫ সালে চ্যালেঞ্জগুলো দেখা দিতে পারে। গণতন্ত্র, নির্বাচন, উত্তেজনাপূর্ণ সংঘাত ও ধ্বংসপ্রবণ প্রযুক্তির উদ্ভাবন দিয়ে শেষ হয়েছে ২০২৪ সাল। তাহলে ২০২৫? জলবায়ু পরিবর্তন ঘিরে বহুপাক্ষিকতা ও পরিস্থিতির উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ এই সময়ে প্রযুক্তির সার্বভৌত্ব অর্জনের পাশাপাশি এটি ব্যবহারে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে সাধারণ মানুষকে। সুরক্ষিত সাইবার পরিস্থিতির ওপরই নির্ভর করবে ভূখন্ডের শান্তি। উন্নয়ন আর প্রশান্তির মেলবন্ধন নির্ভর করবে সামগ্রিক স্বচ্ছতার ওপর।
সূত্র: ডিজিবাংলা